কিশোরী ও কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ, গর্ভপাতের অভিযোগে বহিস্কৃত ছাত্রলীগ নেতা গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ঢাকার সাভারে আলোচিত ১৪ বছরের স্কুলপড়ুয়া এক কিশোরী ধর্ষণের পর কলেজছাত্রীকে (২৩) স্ত্রী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে ধর্ষণ ও জোরপূর্বক একাধিকবার গর্ভপাতের অভিযোগে বহিস্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুরে ভুক্তভোগী ওই কলেজ ছাত্রীর দায়ের করা মামলায় পলাতক থাকা অবস্থায় মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার শায়েস্তা ইউনিয়নের সাহরাইল এলাকার আয়েশা সিদ্দিকা মহিলা মাদ্রাসার দোতালায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে সাভার মডেল থানা পুলিশ।

সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সাভার মডেল থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এস আই) রাজীব শিকদার বলেন, গত ২ ফেব্রুয়ারি সাহরাইল গ্রামের আফসার উদ্দিনের বড় মেয়ে আফসানা আক্তার মীমকে (২১) বিয়ে করে আত্মগোপনে ছিলেন ধর্ষক সোহেল রানা। বুধবার দুপুরে নব্য শশুরবাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

থানা পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, এর আগেও সাভার পৌরসভার রাজাবাড়ি মজিদপুর এলাকায় ওই ছাত্রলীগ নেতার ভাড়া বাসায় জিম্মি করে স্কুলছাত্রী কিশোরীকে ধর্ষণের পর ভিডিও ধারণের মামলায় ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সাভার সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানাকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। আলোচিত ওই ঘটনায় ছাত্রলীগ থেকে সোহেল রানাকে বহিষ্কার করে কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

ভুক্তভোগী কলেজছাত্রীর অভিযোগ, ২০১৬ সালে কলেজে পড়া অবস্থায় সোহেল রানা ওই কলেজ ছাত্রীকে জিম্মি করে অপ্রাপ্ত বয়সে ধর্ষণ করে। সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও চিত্র ধারণ করে ইন্টারনেটে ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সময় একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক ও বিয়ে ছাড়াই স্ত্রী পরিচয়ে কলেজ ছাত্রীকে থাকতে বাধ্য করে অভিযুক্ত সোহেল রানা। একপর্যায়ে ওই ছাত্রী তিনি গর্ভধারণ করে এবং  বিষয়টি সোহেল রানাকে জানিয়ে বিয়ের চাপ দিলে বিভিন্ন সময়ে ৪ বার নির্যাতন করে জোরপূর্বক ওষুধ সেবন করিয়ে ওই ছাত্রীর গর্ভপাত ঘটায়। সর্বশেষ পঞ্চম বারের ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি রাত সাড়ে নয়টায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে জোরপূর্বক ৩১ জানুয়ারি গভীর রাতে সোহেল রানার মা হামিদা বেগমসহ তাঁকে বেধে রেখে গর্ভপাতের ওষুধ খাওয়ান। এরপর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে পালিয়ে সিংগাইর এলাকায় মাদ্রাসা ছাত্রী মীমকে বিয়ে করে আত্মগোপনে ছিলেন।

বিষয়টি সোহেল রানার পরিবার ও তার পরিবারের সদস্যদের  জানান। তবে তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি। এরপর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ঘটনাটি সম্পর্কে জানিয়ে এর বিচার চান ভুক্তভোগী। এরপরও তিনি কোনো প্রতিকার পাননি। উল্টো সোহেল রানা তাঁকে হুমকি দেয়ায় আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার কারনে একটি মামলার আসামী হওয়ায় অপমানে আত্মহত্যারও চেষ্টাও করেছি। কোথাও বিচার না পেয়ে ঘটনার বিষয়টি সাভার মডেল থানায় অবগত করেন।

এর আগে ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৪ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে সোহেল রানার বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা নং-৬৫ রুজু হয়। সেই মামলায় গ্রেপ্তারের পর ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে আপস মীমাংসার মাধ্যমে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন সোহেল রানা। ওই মামলা থেকে বাঁচতে ভুক্তভোগী কলেজ ছাত্রীর পরিবার থেকে ৬ লাখ টাকা যৌতুক হিসেবে নেন সোহেল রানা।
এলাকাবাসীরা জানায়, সাভার সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি সোহেল রানার বিরুদ্ধে যৌন কেলেংকারী নতুন নয়। এর আগেও তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে প্রতারণা, হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, চাঁদাবাজিসহ আরও বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে মামার বাড়ি আশুলিয়ার বেপজা এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে পরিবার নিয়ে সাভার সদর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের চাপাইন এলাকার বাসিন্দা ইউনুস আলীর বাসা ভাড়া নেন। এরপর শুরু হয় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ। সোহেলের মাদক কারবারিতে জড়িয়ে এলাকার উঠতি বয়সের কোমলমতি তরুণ সমাজ সর্বনাশী ইয়াবায় আসক্ত হয়। মাদক চোরাচালান কালে ২০১৫ সালে মাদকসহ সাভার মডেল থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় সোহেল রানা। মাদক কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হলে সেখান থেকেও এলাকাবাসী তাদের বিতাড়িত করে।

একসময় সাভার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের সামসু মিয়ার বাড়ি ভাড়া নেয় সোহেল রানার পরিবার। বাড়ির মালিক সামসু বাসার ভাড়া চাইলে তাকেও ভাড়া না দিয়ে উল্টো মাদক দিয়ে জড়িয়ে মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করে। তাদের অত্যাচারে প্রতিকার চেয়ে সাভার পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হাফিজ উদ্দিনের কাছে বিচার চায় সামসু। সালিশে না গিয়ে বাসার মালিক বৃদ্ধ সামসুকে বেধড়ক মারধর করে ভাড়া না দিয়ে আসবাবপত্র ও মালামাল নিয়ে চলে যায়।

এরপর ডগরমোড়া উদয়ন স্কুলের পাশে সাভার মডেল কলেজের শিক্ষক বিল্লাল হোসেনের বাড়িতে ভাড়ায় উঠে। সেখানে বসবাস করা অবস্থায় সাভার সদর ইউনিয়নের দেওগাঁও এলাকার মতি মিয়ার ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী কুটু মিয়া(২১) কে কুপিয়ে জখম করে । মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও কুটু তার স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এ ঘটনায় সাভার মডেল থানার মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এর কিছুদিন পূর্বে সাভার পৌরসভার সিআরপি এলাকার বাসিন্দা যুবলীগ নেতা জনিকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায়ও সাভার মডেল থানায় একটি মামলা রেকর্ড হয়, যা আদালতে বিচারাধীন।

সর্বশেষ ধর্ষণ মামলায় জেল থেকে বেরিয়ে সাভার পৌরসভার গেন্ডা এলাকার ব্যবসায়ী ও পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ আলী চুন্নুর কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি ও হত্যা চেষ্টা মামলায় জামিনে রয়েছেন সোহেল রানা।

সাভার সদর ইউনিয়নের ছাত্রলীগ সভাপতির পদ পাওয়ার পর চাপাইন এলাকায় বাড়ি করার জন্য একটি প্লট, সাভারের বংশী নদীর পাড়ে জমি ও রেডিমেড বাড়ি ক্রয়, সাভার ল্যাব জোন হাসপাতাল সংলগ্ন জুয়েল নামে এক ব্যক্তির বাড়ি দখল করে নানা রকম অপকর্মকারী সোহেল রানা ডান্সার রানা নামেও পরিচিত। ডান্সার টিমের নিত্য পরিবেশন করা উঠতি বয়সী মেয়েদের ভুল বুঝিয়ে ব্যবহার করে উচ্চ বিলাসী ধনীর দুলালদের প্রেমের ফাঁদে ফাঁসিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে কোটি টাকার মালিক বনে গেছে।

সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আকবর আলী খান বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারকৃত সোহেল রানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!