সম অধিকার নয় অগ্রাধিকার চাই, সাভারে তরুণ নারী সম্মেলনে-রাশেদা কে. চৌধুরী

সাভার প্রতিনিধিঃ গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী বলেছেন, সর্বক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে কিন্তু অংশীদারিত্ব বাড়েনি, এই জায়গায় আমাদের কাজ করতে হবে। এখন আমরা সম অধিকার নয়, অগ্রাধিকার চাই। এসময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং নারীপক্ষ’র প্রয়াত সদস্য নাসরীন হকের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচ ভবনে নারীপক্ষ’র ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুরু হওয়া ৩ দিন ব্যাপী তরুণ নারী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

‘‘মোরা আকাশের মত বাধাহীন’’ এই শ্লোগানকে ধারন করে আয়োজিত সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, আমরা সবাই রাজনীতি করি, হয়তো অনেকেই কোন দলকে সমর্থন করিনা। সংসারে পুরুষের তুলনায় আমরা অধিক কাজ করলেও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা সবচেয়ে বড়। এজন্য আমাদেরকে আওয়াজ তুলতে হবে। আমি ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত নূন্যতম শিক্ষা করার দাবি জানিয়ে আসলেও গত ১০ বছরেও তা সংসদে পাস হয়নি। তারপরও নিজের প্রতিবাদী অবস্থান ধরে রাখতে হবে।

রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, আমাদের আন্দোলন পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পুরুষ তান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। দেশে শিক্ষার হার এবং মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়লেও অংশীদারিত্ব বাড়েনি। বর্তমানে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঙ্খিত বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। নারীর ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

নারী পক্ষের আয়োজনে সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন নারীপক্ষ’র সভানেত্রী ড. তাসনিম আজীম। এসময় তিনি বেশ কয়েকজন সংগ্রামী নারীর জীবনের কথা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, এবারের তরুণ নারী সম্মেলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে- টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এর আলোকে নারীর অবস্থা ও অবস্থান পরিবর্তনে তরুণ নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং তরুণ নারীদের অংশগ্রহণে নারী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও বিস্তৃতকরণ। এবারের তরুণ নারী সম্মেলনে সারাদেশ থেকে ২০০ জন তরুণ নারীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৩০০ জন নারী অধিকার কর্মী অংশগ্রহণ করেছেন।

সংগ্রামী নারীদের মধ্যে এশিয়া মহাদেশের প্রথম নারী বয়লার অপারেটর জমিলা খাতুন বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উৎসাহ এবং সহযোগিতায় আমি এশিয়া মহাদেশের সর্বপ্রথম লাইসেন্সধারী নারী বয়লার অপারেটর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। আমি শুধু বয়লার চালানো নয়, গ্রীলের কাজসহ যাবতীয় অনেক ধরনের কাজ করেছি। বর্তমানে টঙ্গিতে অবস্থিত গণস্বাস্থ্য বেসিক কেমিক্যালস লিমিটেডে নারী বয়লার অপারেটর হিসেবে কাজ করছি।

সংগ্রামী নারী হাজেরা খাতুন, বলেন, সৎ মায়ের অত্যাচারে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে পথশিশু হিসেবে ভিক্ষাবৃতি, চুরি, টোকাই হওয়া দিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করি। সহকর্মীরা আমাকে মাত্র ১২ বছর বয়সে কান্দু পট্টিতে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করে দেয়। সেখানে যৌনকর্মী হিসেবে জীবন শুরুর পর টানবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ভাসমান যৌনকর্মী হিেেসবেও জীবন কাটিয়েছি। পরবর্তীতে নারীপক্ষ, কেয়ার বাংলাদেশ, কনসার্ণ এদের সহযোগিতায় আমার পেশাগত পরিবর্তন আসে। নারীপক্ষের সাথে কাজ করেই আমি বুঝতে পেরেছি যে আমরাও মানুষ, আমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে”। ২০১০ সাল থেকে তিনি যৌনকর্মীদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য ‘শিশুদের জন্য আমরা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেটি পরিচালনা করছেন।

বেসিক ইউনিয়ন সভাপতি ও ‘‘ফুড বক্স বাই সোমা’’ ফেসবুক পেজের উদ্যোক্তা সোমা আক্তার বলেন, নারীদের পথ চলা অনেক কঠিন, প্রতিবাদ করলেই শুনতে হয় খারাপ মেয়ে, খারাপ নারী। তারপরেও প্রতিবাদ করতে হবে, নিজেকে নিজেই বাঁচাতে হবে, নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। তিনি গার্মেন্টস কর্মী থেকে এখন সফল নারী উদ্যোক্তা হয়েছেন এবং পাশাপাশি শ্রমিক রাজনীতিও করছেন।

সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, একেক জন নারীর লড়াই যেমন একেক রকম, একেক জনের সফলতার গল্পও একেক রকম। কিন্তু প্রতিটি গল্পই আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার। নারীকে ঘরে ও বাইরে দুই ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। নারীকে নিজের শরীরের উপর ও উপার্জনের উপর অধিকার অর্জন করতে হবে। যেখানে প্রতিবন্ধকতা আসবে সেখানেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। রাস্ট্র আমাদেরকে সমধিকার দিলেও সমাজে তার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

সভাপ্রধান হিসেবে নারীপক্ষ’র সভানেত্রী ড. তাসনিম আজীম আগামী ৩ তিন সকলকে প্রত্যেক অধিবেশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আহবান জানান এবং সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে সভা শেষ করেন। অতিথিদের বক্তব্য শেষে “মুক্ত পাখি গানের দল” এর পরিবেশনায় বাউল সঙ্গীত উপস্থাপনের মধ্য নিয়ে ৩ দিন ব্যাপী সম্মেলনের ১ ম দিন সমাপ্ত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!